চেক-ইন প্রাগ
2019-এর মার্চ মাসে আবার আমরা সপরিবারে বেরিয়ে পড়লাম ইউরোপের দু-একটি শহর দেখতে। এবারের গন্তব্য প্রাগ্, ব্রাতিস্লাভা এবং বুদাপেস্ট। যাত্রা শুরু হল প্রাগ দিয়ে। এখানে বলে রাখা ভালো গত দুবছর ধরে আমি ব্রাসেল্সে(বেলজিয়াম) থাকি, স্বামীর কর্মসূত্রে। আমি আমার স্বামী ও আমাদের কন্যা। গত দুবছর এখানে থাকার সুবাদে বেশ কিছু জায়গা, বলা ভালো দেশ দেখার সুযোগ ঘটেছে। ঐ সেনজেন ভিসার সুযোগ কাজে লাগানো বলা যায়। এর আগে নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স ও আরো বেশ কয়েকটি দেশ দেখলেও প্রাগ অর্থাৎ চেক-এ যাওয়ার কথা খুব একটা আমাদের কারোরই মনে হয়নি। কিন্তু ঐ আজকাল আমাদের সোশ্যাল মিডিয়া যেমন অনেক অজানাকে জানতে সাহায্য করে তেমনি প্রাগ যাওয়ার ইচ্ছেটাও জাগিয়ে তুলল। বেশ কিছু পরিচিত-এর প্রাগ ভ্রমণের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখে গত তিন-চারমাস ধরে মনটা বেশ 'প্রাগ প্রাগ' করছিল। তাই এবার মনকে প্রাধান্য দিয়েই প্রাগ- বুদাপেষ্ট এর প্ল্যান করা হল মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে। এর আগে যাওয়াটা খুব একটা সমীচিন মনে হল না, প্রাগের ভৌগলিক অবস্থানের জন্য। ওখানে বেশ ঠান্ডা থাকে। তাই প্ল্যানমতো আমরা ব্রাসেল্স থেকে ফ্লাইটে প্রাগ পৌঁছলাম। পৌঁছতে বেশ খানিক রাত হয়ে যাওয়ায় সেদিন এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা হোটেল চলে গেলাম।
ক্যাসেল থেকে প্রাগ শহর |
পরদিন সকালে ট্রামের 'টুংটুং' শব্দে ঘুম ভাঙলো। ট্রাম হল প্রাগ শহরটির যানব্যবস্থার প্রধান বাহন। হ্যাঁ, শুনতে অবাক লাগলেও সত্যি; আমরা যারা কলকাতা শহরের ট্রাম দেখে বড়ো হয়েছি তাদের কাছে এটা একটু অন্যরকম অভিজ্ঞতা; আমার শহরে ট্রাম হল ভিড়ের বুকে ধীর লয়ে চলা একটি যান, আর এখানে সে শহরের সমস্ত ব্যস্ততাকে অতিক্রম করে দ্রুত গতিতে চলে যাচ্ছে শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। ট্রাম ছাড়াও এখানে রয়েছে মেট্রোরেল এবং শহরের অপেক্ষাকৃত নতুনদিকে কিছু বাস চোখে পড়ে, কিন্তু ট্রামই প্রধান। এরপর ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে চলে গেলাম হোটেলের ডাইনিং হলে ব্রেকফাস্টের জন্য।
প্রাগের রাস্তায় ট্রাম |
এবার বেরিয়ে পড়া প্রাগ দেখতে। হাতে ম্যাপ, চোখে দেখার ক্ষিদে আর মনে অজানাকে জানার ইচ্ছে নিয়ে উঠে বসলাম 'কল আ ক্যাব'এ; গন্তব্য প্রাগ ক্যাসেল( castle)। ড্রাইভারটির কাছ থেকে আমার স্বামী কিছু জানতে চাইছিলেন শহরটির সম্পর্কে, কিন্তু খুব একটা লাভ হলো না, কারণ ভাষা। আমরা যেমন আঞ্চলিক ভাষা জানি না, তেমনি সেও দু-একটা শব্দ ছাড়া ইংরেজি জানে না। কি আর করা যাবে। শুধু দুচোখ ভরে দেখে যাওয়ার পালা আর মাঝেমাঝে রাস্তায় নতুন কিছু দেখে কন্যার উত্তেজনার সঙ্গী হওয়া। মিনিট 15 র মধ্যে আমরা চলে এলাম ক্যাসেলে। জায়গাটি অপেক্ষাকৃত একটু উঁচুতে এবং সেটাই স্বাভাবিক। আগেকার দিনে রাজা এই ক্যাসেল থেকেই পুরো শহরটিকে দেখতেন। এখান থেকে শহরটিকে খুব সুন্দর দেখতে লাগে। ক্যাসেলে প্রবেশের মুহূর্তেই দেখলাম একটি ছোট্ট জটলা এবং সকলের হাতেই প্রায় ক্যামেরা। বুঝলাম প্রহরী পরিবর্তনের সময়, এখানে প্রতি ঘন্টায় প্রহরী পরিবর্তিত হয় এবং সেটা বেশ দেখার জিনিস। আমরাও মুহূর্তটা ক্যামেরাবন্দী করে নিলাম। এরপর ভেতরে প্রবেশ করে চারদিকটা দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম ওখানকার চার্চে। 'সেন্ট ভিটাস্ ক্যাথেড্রাল'( Katedràla Sv.VITA) এটি, বহিরাঙ্গিকে জার্মানির কোলন(cologne) ক্যাথেড্রালের সঙ্গে বেশ মেলে। কয়কটা ছবি তুলে ভেতরে গেলাম। অসম্ভব সুন্দর একটা জায়গা। বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে এলাম ক্যাসেলের বাইরের দিকে, যেখান থেকে পুরো শহরটা দেখা যায়।
চার্লস্ ব্রীজ, প্রাগ |
সৌভাগ্যবশত সেদিন আবহওয়া খুব ভালো ছিল। আর ইউরোপে বেড়াতে এসে এই সুন্দর আবহওয়া পাওয়াটা একটা আলাদা অ্যাডভান্টেজ বলা যায়, আমার দুবছরের ইউরোপ বসবাসের অভিজ্ঞতা এটা। এরপর ক্যাসেল থেকে বেড়িয়ে এক-দেড় কিলোমিটার রাস্তা হাঁটতে থাকলাম, আর দুদিকে কি অসাধারণ স্থাপত্য। এবার সমতলে আসার পালা অর্থাৎ শহরের দিকে। সরু গলি দিয়ে যেতে যেতে দুপাশের স্থাপত্য সত্যি মুগ্ধ করে। দেখে নিলাম আরও একটি চার্চ 'আওয়ার লেডি'(Church Our Lady)।এটি শুধু বাইরে থেকেই দেখলাম। এর খুব কাছেই চার্লস্ ব্রীজ। তবে চার্লস ব্রীজ যাওয়ার পথটি বেশ মনোরম। মাঝে মাঝেই পুরোনো আমলের লাল-কালো ভিন্টেজ গাড়ি দেখা যায়, ট্যুরিস্ট ট্রিপ করার জন্য। আমি আর আমার মেয়ে গাড়ির এক মালিকের কাছে অনুমতি নিয়ে একটি ছবি তুলে নিলাম। আর আমরা যেমন জায়গা ঘুরতে ভালোবাসি তেমনি সেই জায়গার খাবারও চেখে দেখি। তাই এবার একটি দোকানে ঢুকলাম, চিমনি কেকের দোকান। এটি ওখানে আমাদের সামনেই তৈরী হচ্ছে, এটি আর পাঁচটা সাধারণ কেকের মতো নয়। দেখতে অনেকটা আমাদের অতি পরিচিত ক্রীম রোলের মতো, তবে একটু বড়। আর এটা ক্রীমসহ বা ক্রীম ছাড়া দুরকমভাবেই খাওয়া যায়। আমরা নিলাম চিমনি কেক উইথ স্ট্রবেরি ক্রীম। এটি আগে একবার খেলেও এবার যেন আরো ভালো লাগল। খাওয়া পর্ব সেরে এবার দেখব বিখ্যাত চার্লস্ ব্রীজ। কিন্তু তার আগে আরেকটা জিনিস দেখলাম, 'ন্যারোয়েস্ট লেন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড '(narrowest lane in the world), যেখানে আবার সিগন্যাল ব্যবস্থাও চালু আছে। যাতে দুদিক থেকেই একসাথে লোক যেতে না পারেন এবং চওড়ায় এটি এতই সরু যে একজন লোক কোনোরকমে যেতে পারবে।
চার্লস ব্রীজ শুধু মাত্র হেঁটে ক্রশ করা যায়, এখানে কোনো যানবাহন চলার অনুমতি নেই। এই ব্রীজের কাজ শুরু হয় 1357 সালে, রাজা চতুর্থ চার্লসের সময়কালে এবং কাজ শেষ হয় পঞ্চদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে। এর আগে এখানে একটি ব্রীজ ছিল, যেটা তৈরী হয়েছিল 1154-'72এই সময়কালে। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশতঃ 1342 এর বন্যায় সেটি নষ্ট হয়ে যায় এবং তৈরী হয় আজকের এই ব্রীজটি। ব্রীজটি গড়ে উঠেছে 'ভ্লটাভা'(Vltava) নদীর উপর। এই ব্রীজটি মূলত 'স্টোনব্রীজ' বা 'প্রাগব্রীজ' নামে পরিচিত থাকলেও 1870 সাল থেকে এই 'চার্লস ব্রীজ' নামেই পরিচিত। এবং এক সময় এটিই ছিল প্রাগ ক্যাসেল এবং পুরোনো শহরটির মধ্যে একমাত্র সংযোগ, অবশ্যই স্থলপথে। ব্রীজটির দুদিকে বেশ কিছু স্থাপত্য আছে। একজায়গায় একটি দল খুব সুন্দর যন্ত্রসহযোগে সঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন। এরপর হাঁটতে হাঁটতে আমরা ব্রীজ ক্রশ করে চলে এলাম নদীর অন্যপ্রান্তে, পুরোনো শহরের দিকে। এবার দেখে নেওয়া 'old town square'.
আসলে প্রাগ শহরটা এমনই একটি শহর যেখানে হয়তো ট্যুরিস্ট লিস্ট অনুযায়ী 8-10টি দেখার জায়গা, কিন্তু আসলে শহরটা যদি হেঁটে ঘোরা যায় তবে দেখার জিনিসের অভাব নেই। দুচোখ ভরে শুধু দুদিকে দেখে যেতে হবে, এমনই কিছু স্থাপত্য এখানে আছে। আমার স্বামী আর আমি যতটা পারলাম ক্যামেরাবন্দী করলাম, আর সবটা রাখলাম মনের ক্যামেরায়। এবার যাবার পালা 'অ্যাস্ট্রনমিক্যাল ক্লকে'র(astronomical clock) দিকে। এটা আছে 'ওল্ড টাউন স্কোয়ার'(old town square)-এর কেন্দ্রস্থলে। এরমধ্যে যাওয়ার পথেই দু-একটি 'সিনাগঘ' দেখে নিলাম। যদিও দুটির কোনোটাই ভিতরে প্রবেশ করতে পারিনি, সেখানে সার্ভিস চলার জন্য। এরপর ঠিক পৌনে তিনটে নাগাদ চলে এলাম ক্লকের সামনে। এটি একটি অন্যতম দ্রষ্টব্য স্থান। এটি 1410 সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পৃথিবীর তৃতীয় প্রাচীনতম ক্লক এটি; যেটি এখনো নিয়মিত চলছে। তিনটে বাজতেই ঘন্টা বাজতে শুরু করল এবং বাজলো গুনে গুনে পনেরো (15)বার, এখানে হিসাব চব্বিশ (24) ঘন্টার। এই চত্বরে বেশ কিছু 'স্যুভেনির'-এর দোকান আছে, আর আছে খাবারের দোকান। যেখানে তৈরী হচ্ছে রোষ্টেড পর্ক। এই লোভ কন্ট্রোল আর করা গেল না, কিনেই ফেললাম 'রোষ্টেড পর্ক'-এর একটি অংশ বা এক প্লেট সঙ্গে ব্রেড। আর স্বাদ অপূর্ব। এবং এটি এতটাই পেট ভরিয়ে দিল আমরা বুঝে গেলাম ডিনার করার আর দরকার নেই।
অ্যাস্ট্রনমিক্যাল ক্লক - প্রাগ |
আমাদের দ্রষ্টব্যের লিস্টের অনেকগুলোই আমরা এতক্ষণে দেখে ফেলেছি, এবার দেখার পালা 'ওয়েনসেশলাস স্কোয়ার'(Wenceslas Square)। এই জায়গাটি একটি শপিং স্ট্রীটও বটে। দুপাশে সার দিয়ে নানারকম বিখ্যাত সব ব্র্যান্ডেট দোকান। এর মধ্যে একপশলা বৃষ্টিও হয়ে গেছে। এই জায়গাটি আসলে অন্যতম একটি ব্যবসায়িক এবং সাংস্কৃতিক পীঠস্থান। এখান থেকে চললাম আমরা কাফ্কার রোটেটিং মূর্তি দেখতে। এই 'ফ্রান্স কাফ্কা'র রোটেটিং মুখটি (Head of Franz Kafka) 42টি প্যানেল দিয়ে তৈরী। কাফ্কা ছিলেন একজন বিখ্যাত জার্মান লেখক। এবার দেখার পালা 'ডান্সিং বিল্ডিং'(dancing building)। এই বিল্ডিং দেখে আবার ভ্লাটাভা নদীর ধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চললাম চার্লস ব্রীজের দিকে। সূর্যাস্তের সময় আসন্ন আর এখন বড়ো সুন্দর লাগে এই ব্রীজটি।
প্রাগে সূর্যাস্ত |
নদীর ওপর সূর্যাস্ত-এর লাল আভা পরিবেশটিকে বড়ো মোহময়ী করে তোলে। এর আগে জলের ওপর সূর্যাস্ত ভেনিসেও দেখেছিলাম, অসাধারণ অভিজ্ঞতা। ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে এল আর হঠাৎ করেই যেন সারাদিন ধরে দেখা শহরটা অন্যরকম হয়ে গেল। নদীর ওপারে উঁচুতে ক্যাসেলের আলো জ্বলে উঠেছে। চার্লস ব্রীজও যেন আরো সুন্দর হয়ে গেছে। প্রাগ শহরটি এমনই, দিনে ও রাতে সে তার দুরকম রূপ লাবণ্য নিয়ে আমাদের মোহিত করে। নদীর ধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আবার এগিয়ে চললাম ব্রীজের দিকে। মাঝে একটি মার্কেট, সেখান থেকে কিনে নিলাম প্রাগ-এর স্মৃতিস্বরূপ কিছু স্যুভেনির। এবার চার্লস ব্রীজ। কিছু ছবি তুললাম কিন্তু বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারলাম না, প্রচন্ড ঠান্ডার জন্য। তখন সন্ধ্যে সাতটা, তাপমাত্রা 3°/4°c; সঙ্গে নদীর ধারে হাওয়াও দিচ্ছে খুব। আমরা তিনজনই প্রায় হি হি করে কাঁপছি। এবার ঘরে ফেরার পালা কিন্তু মন তো যেতে চায় না। বারবার ঘুরে দেখা রাতের চার্লস ব্রীজকে। এরপর 10-15 মিনিটের মধ্যে আমাদের ক্যাব এসে গেল আর আমরা শ্রান্ত শরীরে চললাম হোটেলে।
হ্যাঁ, পরদিন সকালেই আমাদের প্রাগ ছেড়ে চলে যেতে হবে। অসম্ভব সুন্দর একটি শহর। আমাদের হাতে সময় অত্যন্ত কম থাকায় আমরা একদিনেই পুরো শহরটা দেখলাম। মনে হলো আরো একদিন থাকলে ভালো হত। ইউরোপের অনেকগুলো শহর দেখার সুযোগ হয়েছে আমাদের। প্রত্যেকটি শহরই তাদের রূপ বৈচিত্র্যে সুন্দর, কিন্তু প্রাগ কোথাও যেন আলাদা তাদের থেকে, তার রূপ ও লাবণ্যে নাকি অন্য কিছুতে, তা জানিনা। এই শহরের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে যেমন দেখা যায় ল্যাম্পপোষ্টের মতো উঁচু জায়গা থেকে কেউ হয়তো ছাতা নিয়ে ঝুলছে বা আবার কেউ হয়তো রাস্তায় বেঞ্চের ধারে বসে আছে, হ্যাঁ এগুলো সবই মূর্তি। আরো একটা জিনিস আমাদের তো বটেই আমাদের সাত বছরের কন্যাটিকেও বড় আকৃষ্ট করেছে - সেটা হল এখানকার ল্যাম্পপোষ্টগুলো। এখানকার মানুষের ফুটবল প্রেমের প্রকাশ সেগুলো; লাইট বলে মনেই হয় না, মনে হয় যেন একটি সত্যিকারের ফুটবলই ঝুলছে। এবার যাবার বেলায় বারবার করে মনে হচ্ছে ভাগ্যিস এসেছিলাম, না এলে বড়ো মিস করতাম। পরদিন সকালে চলে যেতে আমাদের। ভালো থেকো প্রাগ্, আরও যুগ যুগ ধরে তোমার স্থাপত্য, ঐতিহ্য আর ইতিহাস নিয়ে আরো অগণিত পর্যটকের মনোরঞ্জন করো।
সুমনা
26.03.19
Khub valo hoyeche
ReplyDeleteThanks
DeleteKhub Bhalo laglo
ReplyDeleteThanks
DeleteBha...khub bhalo laglo, anekdin age gechi, smriti jatotuku abcha hoyechilo ta abar mone koriye dile...👍 Porer lekhar apekhay roilam...
ReplyDeleteThanks
Delete