ফ্লোরেন্টাইন ক্রিস্টমাস
"ইতালি কখনোই একটি সাধারণ দেশ নয়। ইতালি ইতালিই। ইতালি যদি এক সাধারণ দেশ হয় তবে সেখানে রোম থাকত না, থাকত না ফ্লোরেন্স'ও; এমনকি ভেনিসের মতো একেবারে অন্যরকম শহরও বোধহয় থাকত না।"-কথাগুলো খুব একটা ভুল বলেননি ইতালীর প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মাত্তেয় রেঞ্জি (Matteo Renzi)। সত্যিই তো ইতালি এমনই একটি দেশ যে তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর শৈল্পিক ইতিহাস দিয়ে আমাদের আজীবন মুগ্ধ করে রাখতে পারে। মানবসভ্যতার ইতিহাস সমৃদ্ধ এক দেশ এই ইতালি।
ইউরোপ মহাদেশের নাম করতে প্রথমেই যে কয়েকটি দেশের নাম মনে আসে তার মধ্যে ইতালি অন্যতম। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। তাই ইতালির প্রতি আকর্ষণ সেই ইউরোপ প্রবাসের অনেকদিন আগে থেকেই, বলা ভালো সেই ছোট্টবেলা থেকে। আর হবে নাই বা কেন, আমরা তো ইতিহাস যেদিন থেকে পড়ছি সেদিন থেকেই জেনেছি রোম সভ্যতার নাম। আরো বড়ো হয়ে জেনেছি ফ্লোরেন্সের কথা, বুঝেছি রেনেসাঁর গুরুত্ব। তাই এহেন একটি শহরকে ছুঁয়ে দেখার সাধ কার না হয়। আর সেই মতো আমরা ঠিক করলাম দ্বিতীয়বারের জন্য আবার ইতালি যাওয়া হবে, ঘুরে দেখা হবে ফ্লোরেন্স নাইটেঙ্গলের শহর, ২০১৯ এর ক্রিস্টমাসটা না হয় ফ্লোরেন্টাইন ক্রিস্টমাসই হোক।
ক্রিস্টমাসের কদিন আগে আমরা পৌঁছলাম ফ্লোরেন্স। পৌঁছতে মোটামুটি বিকেল হয়ে গেল। আমরা এসেছি ট্রেণে পিসা থেকে। স্টেশনের কাছেই হোটেল, তাই হেঁটেই চলে গেলাম, জিনিসপত্র রেখে একটু ফ্রেশ হয়েই এবার বেরিয়ে পড়া ইতিহাসের শহর ফ্লোরেন্স দেখতে। হোটেল থেকে মাত্র ৫০০ মিটার দূরেই ফ্লোরেন্সের প্রধান আকর্ষণ 'সান্তা মারিয়া দেল ফিওরে'(Cathedral Santa Maria Del Fiore) অর্থাৎ ফ্লোরেন্স ক্যাথেড্রাল। আহা, কি অপূর্ব সুন্দর সৃষ্টি বিখ্যাত স্থপতি ফিলিপ ব্রুণেলেস্কি'র (Filippo Brunelleschi)। এখন শুধু বাইরে থেকেই দেখলাম।ভেতরে যাওয়ার সময়সীমা প্রায় শেষের পথে। ঠিক হল পরেরদিন সকালে আবার আসা হবে। এখন যাওয়া হবে এখান থেকে একটু দূরে শহরের অন্যপ্রান্তে 'পিয়াজেলে মাইকেলএঞ্জেলো'(Piazzale Michelangelo)-তে। শুনেছি জায়গাটা অপেক্ষাকৃত একটু উঁচু হওয়ার দরুণ খুব সুন্দর সূর্যাস্ত দেখা যায়। আর এই ডিসেম্বর মাসে ঝুপ্ করেই যেন সন্ধ্যে নামে তাই হাতে বেশি সময় নেই। দ্রুত পায়ে চলেছি,বেশ কিছু সিঁড়ি আছে পথের শেষপ্রান্তে; একটু হাঁপিয়েই গেলাম সবাই। বেশ লোকজনের ভিড় রয়েছে, সবাই ছবি তুলতে ব্যস্ত। এখান থেকে পুরো শহরটা দেখা যায়,আর সত্যিই কি অপূর্বই না লাগছে গোধূলির এই সোনালী আভায়। আর গোল্ডেন আওয়ার (golden hour) এ ফ্লোরেন্স ডুমো (Duomo Florence) যেন আরো বেশি সুন্দর হয়ে উঠেছে। এখন ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামছে, ভীড়ও একটু হাল্কা হচ্ছে। এখানে মাইকেল এঞ্জেলোর একটি বিশ্ববিখ্যাত ভাস্কর্য ডেভিডের মূর্তি আছে। আর চারদিকে রয়েছে অন্যান্য পর্যটন কেন্দ্রের মতোই রয়েছে প্রচুর স্যুভেনির শপ আর কফি শপ। বেশিরভাগ দোকানই তাদের ঝাঁপ ফেলতে ব্যস্ত সেদিনের মতো। কিছু কফিশপ খোলা আছে, আমরা গিয়ে বসলাম একটাতে; ঐ কফি আর জেলাতো (gelato) আইসক্রিম খেতে খেতে সন্ধ্যার মায়াবী ফ্লোরেন্সকে উপভোগ করা আর কি।
পোন্তে ভ্যাকো |
এবার ফেরার পালা। আর্ণ (Arno) নদী গোটা শহরটাকে দুভাগে ভাগ করে দিয়েছে। আমরা নদীর ধার দিয়ে হাঁটতে থাকলাম, মাঝে আছে কয়েকটা ছোট ছোট ব্রীজ। তার মধ্যে বিখ্যাত হল 'পোন্তে ভ্যাকো' (Ponte Vacchio)। ইতালীয় ভাষায় পোন্তে শব্দের অর্থ হল ব্রীজ। জায়গাটি বেশ জমজমাট।আর ক্রিস্টমাসের সময় পুরো শহরটাই আলোর সাজে এত সুন্দর করে সেজে উঠেছে বলে দেখতে বড্ড ভালো লাগে। এই ব্রীজের দুধারে রয়েছে অগুনতি অলংকারের দোকান। এই রাস্তাটা পুরোটাই শপিং স্ট্রীট। আর চারদিকে দোকান থাকায় খুব জমজমাট। আর ক্রিস্টমাস উপলক্ষ্যে বেশ কিছু জায়গা এত সুন্দর করে সাজানো, সঙ্গে রয়েছে মেরি গো রাউন্ড। যেন মনে হচ্ছে মেলা বসেছে। এখন আমরা হোটেলের পথে, মাঝে ডিনার সেরে নেওয়া। এরই মধ্যে আরো একবার দেখে এলাম ফ্লোরেন্স ক্যাথেড্রাল।
ক্যাথেড্রাল সান্তা মারিয়া দেল ফিওরে |
পরদিন সকাল সকাল ঘুম ভাঙলো বেশ, বেরোতে হবে যে। আগের দিন জেনে এসেছি ক্যাথেড্রালের দরজা সাধারণের জন্য খোলা হয় সকাল ১০টায়। তাই আর সময় নষ্ট না করে স্নান সেরে চলে এলাম হোটেলের ডাইনিং হলে ব্রেকফাস্টের জন্য। এবার বেরিয়ে পড়া ফ্লোরেন্স দেখতে। ডুমোর সামনে পৌঁছে দেখলাম ইতিমধ্যেই বেশ লম্বা লাইন হয়ে গেছে ভেতরে যাওয়ার জন্য এবং দরজা এখনো খোলেনি। আমরাও লাইনে দাঁড়ালাম তবে তিনজন নয় দুজন, আর একজন কখনো আমার স্বামী বা কখনো আমি মন ভরে ছবি তুলে নিলাম পঞ্চদশ শতকের অসাধারন এই স্থাপত্যটির। হাতে এখনো বেশ খানিক সময় আছে ভেতরে যাওয়ার জন্য। এই ক্যাথেড্রালের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু - 'পিয়াজা দ্য ডুমো'(Piazza del Duomo), সঙ্গে রয়েছে ব্যাপটিস্ট্রি(Baptistery) আর গিয়েত্তো'র (Giotto's) বেলটাওয়ার। এই তিনটি একত্রে UNESCO ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট (world heritage site) হিসাবে ঘোষিত। এর ব্যাসিলিকাটি ইতালির অন্যতম বৃহত্তম একটি চার্চ আর ডুমোটি পৃথিবীর বৃহত্তম। আরেকটা কথা বহিরাঙ্গিকে টেরাকোটা সমৃদ্ধ এই ক্যাথেড্রালটি হল 'Roman Catholic Archdiocese of Florence'র মাদার চার্চ।
ফ্লোরেন্স ক্যাথেড্রাল |
এবার প্রবেশ অন্দরে। গথিক স্টাইলের বৃহত্ এই চার্চের অন্দরমহলের অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে সময়ের সাথে সাথে। তবে এখনো যা আছে তাও এক বিস্ময়। এর ডুমোটিতে ওঠা যায়, তবে আমরা যাওয়ার ভরসা পাইনি পরিবারের ক্ষুদে সদস্যটির কথা ভেবে। প্রায় ৪৫০টি সিঁড়ি আছে ওপরে ওঠার জন্য এবং তা বেশ অপ্রশস্ত। তাই আমাদের আট বছরের কন্যাটির কাছে বোধহয় সেটা একটু বেশিই দুর্গম হয়ে উঠত, তাই আর গেলাম না।
সান্তা ক্রশ চার্চ |
এরপর গেলাম 'পালাজো ভ্যাকো' (Palazzo Vacchio), এটি এখানকার টাউনহল। ত্রয়োদশ শতকে তৈরী এই টাউনহলটি নবজাগরণের ইতিহাস বহন করে চলেছে আজও। ভাস্কর্যে ভরপুর এই চত্বরটি, আছে তার গ্যালারি। আরো আছে 'Fountain of Neptune', যার ইতালীয় নাম 'Fontana del Nettuno'। মার্বেল পাথর আর ব্রোঞ্জের সংমিশ্রণে তৈরী এই ফাউন্টেনটি প্রায় ৫০০ বছরের পুরোনো। বলাই বাহুল্য ইতালীয় ভাস্কর্যের আরেক উল্লেখযোগ্য নিদর্শন এটি। এই চত্বরে আরো একটা জিনিস দেখে বেশ অবাক লাগল; তিন চাকার রিক্সা। হ্যাঁ, আমরা কলকাতার রাস্তায় যে রিক্সা দেখি গড়নে তার চেয়ে একটু আলাদা, ঐ ইতালীয় ধাঁচ আর কি; তবে উদ্দেশ্যটা কিন্তু এক। এখানে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে আমরা চলেছি পরবর্তী গন্তব্যে - 'সান্তা ক্রশ চার্চ' (Basilica of Santa Croce), কি সুন্দর চার্চটি। এরই প্রাঙ্গণে ফ্লোরেন্সের ক্রিস্টমাস মার্কেটটি বসে, যদিও আমরা ফ্লোরেন্স পৌঁছনোর দুদিন আগেই সেটির সমাপ্তি ঘটেছে। আর চার্চের অন্তর্সজ্জা, এককথায় অসাধারন, বেশ জমকালো। আমি অন্তত এর আগে এরকম জমকালো চার্চ দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। আর একজনের কথা এখানে বলতেই হয়, তিনি এই চার্চের গাইড। সত্তোরর্দ্ধ সেই মানুষটি তার অসাধারন বাচনভঙ্গিতে ফ্লোরেন্স শহরের ইতিহাস কি সুন্দরভাবে আমাদের সামনে জীবন্ত করে তুলে ধরেছেন।
Pitti Palace |
মাথার উপর সূর্য এখন, পেটও জানান দিচ্ছে লাঞ্চ করতে হবে; তাই পথেই লাঞ্চ সেরে নিলাম। প্রায় ২০০০ বছরের পুরোনো শহরের অলিগলি ঘুরতে ঘুরতে বারবার মনে হয়েছে, ছোটবেলায় শোনা একটা কথা; 'ইতিহাস কথা বলে' আজ তা উপলব্ধি করলাম। এবার আমরা যাচ্ছি 'Pitti Palace'; এখান থেকেই নবজাগরণ আন্দোলন শুরু হয়েছিল। এটা দেখে আজ আবার যাবো 'পোন্তে ভ্যাকো'। মধ্যযুগীয় এই ব্রীজটিতে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে চললাম 'উফিজি গ্যালারি' (Uffizi Gallery) চত্বরে। এখানকার রাস্তা একটু সরু আর দুদিকে সব পুরোনো পুরোনো বাড়ি। বড়ো ভালো লাগছিল এখান দিয়ে হাঁটতে। চারদিকে বেশ ক্রিস্টমাসের আমেজ, বেশ কিছু দোকানে বেশ ভীড়; আর হবে নাই বা কেন, বড়দিন বলে কথা।
ফ্লোরেন্সের অলিগলি |
এই রাস্তা দিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে শহরটা ভালো করে দেখতে দেখতে চললাম আমরা নদীর অন্যপ্রান্তে আরেকটি শপিং স্ট্রীটের দিকে। এই রাস্তার দুদিকে যেমন বেশ নামীদামি দোকান তেমনি রাস্তাটাও খুব সুন্দর করে সাজানো হয় এ সময়। শুধু ফ্লোরেন্স নয়, এখানকার সব শহরের শপিং স্ট্রীটগুলোর চেহারাই এই সময় একটু অন্যরকম হয়ে যায়; সে ব্রাসেল্স, রোম, লন্ডন সব জায়গারই। আর্ণ নদী পেরিয়ে এই শপিং স্ট্রীট - 'তুরনাবুয়োনি'তে (Tornabuoni) এসে যখন পৌঁছলাম তখন সূর্য্যিমামা পাটে বসেছেন। মনটা বেশ আনন্দে নেচে উঠলো, হয়তো আজ আরো একবার গোধূলির সোনালী আভায় ফ্লোরেন্সকে দেখতে পাবো। এখানে চুপি চুপি একটা কথা বলে রাখি - আমার আট বছরের ফোক্কর কন্যাটি এই 'তুরনাবয়োনি' নামক রাস্তাটির নাম দিয়েছে 'তোর বউ নাই?'; তার নাকি ভারি মজা লেগেছে এই নামটিতে। আহা কি সুন্দর করে সাজানো রাস্তাটি আর দেখতে দেখতে কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো আকাশ জুড়ে সোনালী আলো যেন খেলা করতে শুরু করল। কি অপূর্ব সে দৃশ্য। বেশ লাগল পরপর দুদিন এই 'গোল্ডেন আওয়ার'-এ ফ্লোরেন্সকে দেখতে।
গোধূলির সোনালী আভায় 'তুরনাবুয়োনি' |
সন্ধ্যে হয়ে গেছে, পথে উপছে পড়া ভীড়। রাস্তার ধারে মাঝে মাঝেই কোথাও গীফ্টবক্স, কোথাওবা বল রয়েছে বিশালাকার, সবই আলোর তৈরী। সবলোক সেখানে ভীড় করেছে ছবি তোলার জন্য, আমরাই বা বাদ যাই কেন। বাচ্ছাদের কারো হাতে বেলুন, কারো চোখে বেশ রংবেরঙের লাইট জ্বলা চশমা, কারো বা ক্রিস্টমাস টুপিতে আলো জ্বলছে, কি সুন্দর সে দৃশ্য। আহা এরকমই যদি বছরের বাকি দিনগুলোও আমরা আনন্দ মজা করে কাটাতে পারতাম; কি জানি তাহলে হয়তো এই মজা মূল্যহীন হয়ে যেত আমাদের কাছে। হঠাৎ করেই বুঝতে পারলাম এরকম ছবি তুলতে তুলতে আনন্দে গা ভাসাতে ভাসাতে আমরা অনেকটা চলে এসেছি। এখন চারদিকে শুধুই রঙিন আলোর খেলা আর রাস্তার ধারের রেস্টুরেন্টগুলোতে টুংটাং গ্লাস আর কাঁটাচামচের রিনরিনে শব্দ মনকে যেন নাচিয়ে তুলেছে। পথে মাঝে মাঝেই দেখলাম পিঠে ইয়া বড়ো ঝোলা নিয়ে সান্তাক্লজ ঘুরে বেড়াচ্ছে। পথচলতি মানুষের সঙ্গে ছবিও তুলছেন অর্থের বিনিময়ে, এটাই তাদের আজকের রোজগার। আমরাও ছবি তুলেছি মেয়ের আব্দারে।
ফ্লোরেন্সের ক্রিস্টমাস লাইট |
ধীরে ধীরে ক্লান্তি বশ করছে আমাদের। তাই আর বেশি দেরি না করে ঢুকে পড়লাম একটা রেস্টুরেন্টে। আজ পিৎজা খেতে চেয়েছে ক্ষুদে সদস্যটি। আর সত্যিই তো ইতালিতে এসে যদি পিৎজা না খাই তবে তা মহাপাপ হবে বোধহয়। এখানকার পিৎজা একেবারেই অন্যরকম। তাই আজ নৈশভোজ সারা হল পিৎজা আর রিসোতো সহযোগে। আগামীকাল ফ্লোরেন্স ছাড়ার পালা। নাঃ মন খারাপ হয়নি, বরং খুব খুশি। যা দেখতে এসেছিলাম, পেয়েছি তার চেয়ে অনেক বেশি। কি দারুন কাটলো এই দুটো দিন। কি অপূর্ব সুন্দর একটি ছোট্ট এই ঐতিহাসিক শহর ফ্লোরেন্স। যেখানে পরতে পরতে ইতিহাস কথা বলে। যে শহর রেনেসাঁ আন্দোলনের সাক্ষ্য বহন করে সেখানে কাটানো দুটো দিন অবশ্যই স্মরণীয় হয়ে থাকবে আমাদের স্মৃতির কোটরে; আর তার সঙ্গে ২০১৯ এর ফ্লোরেন্টাইন ক্রিস্টমাসও।
সুমনা
৫।৭।২০২০
Comments
Post a Comment