মোহময়ী গিথোর্ণ ( Charming Giethoorn)
এবারের আমাদের গন্তব্য গিথোর্ণ(Giethoorn)। হল্যান্ড বা নেদারল্যান্ডসের উত্তরের একটি ছোট্ট গ্রাম। চারদিক জলবেষ্টিত এই গ্রামটিকে 'ভেনিস অব নর্থ'(Venice of North)ও বলা হয়। অত্যন্ত ছোট্ট একটি গ্রাম এই গিথোর্ণ। মাত্র 2600 লোক এখানে বাস করেন। এখানে যোগাযোগ তথা যাতায়াত ব্যবস্থার একটিই মাধ্যম - জলপথ। আর আছে ছোট ছোট কাঠের সাঁকো। খুব সুন্দর সে দৃশ্য; দুদিকে মনোরম কটেজ আর মাঝে বয়ে চলেছে ক্যানাল, এপার থেকে ওপারে যেতে গেলে পেরোতে হবে কাঠের ব্রীজ। আর এখানে কোনো গাড়ি চলে না, তাই বলা হয় 'car free village '।
গিথোর্ণ-এর পটারি হাউস |
তাই অগাস্ট মাসের এক শনিবার আমরা ঠিক করলাম এহেন সুন্দর এই গ্রামটি দেখে আসা যাক। ব্রাসেল্স থেকে যেতে সময় লাগে ঘন্টা চারেক। এবার আর আমরা একা নই, গেলাম এখানকারই একটি ভারতীয় ট্যুরিস্ট গ্রুপের সাথে। এখন এখানে গ্রীষ্মকাল এবং খুব মনোরম আবহওয়া। আমার গত তিন বছর এই ব্রাসেল্সে থাকার সুবাদে বলতে পারি 2019 এর summer/ গ্রীষ্মটা সত্যিই বেশ ভালো আগেরগুলোর তুলনায়। এই সময়টা তাই খুব ভালো করে বেড়ানো যায়। আমরাও সেই সুন্দর আবহাওয়ারই সুযোগ নিলাম বলা যায়।
সকাল 6 টায় আমাদের বাস গিথোর্ণ-এর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো আর আমরা গন্তব্যে পৌঁছলাম বেলা 10টা নাগাদ। বাস থেকে নেমে সবাই মিলে গেলাম গ্রামের ভিতরে, ক্যানালের ধারে। অনেক জন ছিলাম বলে আমরা বড়ো বোটে উঠলাম। এরই মধ্যে আকাশ কালো করে হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টি এলো। আবার পাঁচ মিনিট পরে থেমেও গেল এবং বলাই বাহুল্য সকলেই স্বস্তি পেলাম। বেড়াতে এসে এই বৃষ্টি আর কারই বা ভালো লাগে। ইউরোপের আবহাওয়াই এরকম। যাই হোক বৃষ্টি থেমে গেলেও আকাশের ভ্রূকুটি থেকে তখনও রক্ষা পাওয়া যায়নি। এবার ঐ বোটে করে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। একেকটা বোটে মোট জনা পঞ্চাশেক লোক বসতে পারে।
গিথোর্ণ-এর নৌকাবিহার |
বোটে করে যেতে যেতে চারদিকের ছোট ছোট বাড়ি, গাছপালা সবমিলিয়ে এক মনোরম পরিবেশ আমাদের সকলকেই মুগ্ধ করে। এক ঘন্টার এই নৌকাবিহার শেষে আমরা আবার চলে এলাম ক্যানালের শেষ প্রান্তে। এই নৌকাবিহারের মাঝেই পেলাম একটি সুন্দর লেক, না সেটি প্রাকৃতিক নয়, কৃত্রিম উপায়ে তৈরী অর্থাৎ মনুষ্য নির্মিত; এবং সেইটি এই ক্যানালগুলোকে যুক্ত করেছে। এবার একটু হালকা জলযোগ সেরে গ্রাম দেখার পালা। এখানে বলে রাখা ভালো, এখানে সে অর্থে কোনো রাস্তা নেই। মাটি অত্যন্ত নরম হওয়ার কারণে রাস্তা তৈরী করা যায়নি এখানে। তাই ক্যানালের ধার দিয়ে যেটুকু রাস্তা আছে সেখান দিয়েই চললাম। এখানে ফার্ম হাউস'ই বেশি। অনেক ব্রীজ থাকলেও এর মধ্যে বেশ কিছু আছে প্রাইভেট। তাই সেগুলো বন্ধ থাকে। লোকজনের বাড়ির সামনে কি সুন্দর বাগান; তাতে আপেল, নাসপাতি(pears), প্লাম কি সুন্দর সব ফল হয়েছে। আমার সাড়ে সাত বছরের কন্যা তো এত ফল গাছ দেখে বেশ আপ্লুত, আমরাও কিছু কম যাই না। গ্রামের মাঝখানে সিটি সেন্টার, কিছু রেষ্টুরেন্টও আছে সেখানে। আর আছে কিছু স্যুভেনির শপ। দু একটা স্যুভেনির কিনে বসে পড়লাম একটা রেষ্টুরেন্টে। এখানে বলে রাখি, আবহওয়া আমাদের সাথ দিয়েছে এখন, রোদে ঝলমল করছে গিথোর্ণ।
এভাবে চারদিক দেখতে দেখতে একসময় চলে এলাম গ্রামের অন্য এক প্রান্তে। সেখানে আবার একটি পটারি হাউস আছে। ভিতরে গিয়ে মালিকের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম এই গ্রামটি অনেক পুরোনো। এমনকি ঐ বাড়িটিও 1900 সালে তৈরী। এখানে ঘুরতে ঘুরতে একটা কথাই বারবার মনে হলো; কি সুন্দর প্রকৃতির কাছে থাকে এরা, দূষণহীন এক সুন্দর পরিবেশ। এবার আবার ফেরার পালা। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে দেখলাম এক জায়গায় অনেক প্লাম পড়ে রয়েছে, লোভ সামলাতে পারলাম না, তুলে নিলাম একটা, কি অপূর্ব স্বাদ, এ স্বাদের ভাগ হবে না।
পথে যেতে যেতে মন ভরে কিছু ছবি তুলে নিলাম। মোবাইল স্ক্রিনে ছবিগুলো দেখে বারবার মনে হলো; হ্যাঁ, এই তো সেই ছবি, যা ছোটবেলায় ঘরের দেওয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডার দেখেছি আর ভেবেছি এরকম জায়গা কি সত্যিই হয় নাকি এগুলো শুধুই আঁকা। আজ বুঝলাম সেগুলো আঁকা ছিল না, হয়তো এই গিথোর্ণ-এর ছবিই ছিল। সত্যিই নিজেকে বড় ভাগ্যবান মনে হয় এই সব মুহূর্তে, যা ছোট্ট থেকে দেওয়ালের ক্যালেন্ডারে দেখে অভিভূত হয়েছি তাকে সত্যিকারের ছুঁয়ে দেখার সুযোগ কজনের ভাগ্যে জোটে।
গিথোর্ণ-এর স্যুভেনির শপ |
এবার ফেরার পালা, তাই আরো একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া সেই সৌন্দর্যের প্রতি। এই নিয়ে আমরা পাঁচবার হল্যান্ডে এলাম, এবং প্রত্যেকবার ফিরেছি একেকরকম অভিজ্ঞতা নিয়ে।বলাই বাহুল্য সবগুলোই খুব মধুর। কখনো মুগ্ধ করেছে এখানকার টিউলিপ, কখনো ব্যস্ত শহর, আবার কখনো এখানকার এক গুহার ভিতরে অতি প্রাচীন ক্রিষ্টমাস মার্কেট অথবা সারাদিন তুষারপাতের মধ্যে অ্যানিমাল সাফারি। হল্যান্ড সত্যিই তুমি সুন্দর আর গিথোর্ণ তোমার 'ভেনিস অব নর্থ' নামটা সত্যিই সার্থক।
সুমনা
23.08.19
Comments
Post a Comment