করোনা'র যাতনা
উফফ! ধুর ভাল লাগে না। এই একটা শব্দ যেন জীবনটা পুরো শেষ করে দিল। আরে হ্যাঁ রে বাবা ঐ করোনার কথাই বলছি। সেই ছোট্ট বেলা থেকে এই শব্দটির সাথে পরিচিতি। না করোনার ছোটবেলা বলছি না, আমাদের ছোটবেলা। ছোট থেকে আমরা কয়েকটা জিনিস, না বলা ভালো কয়েকটা শব্দ (নেতিবাচক) শুনে প্রত্যেকেই বড় হয়েছি। তার মধ্যে করোনা বা কোরোনা একটি অন্যতম। এটা করোনা, ওটা করোনা, সেটা করোনা। সত্যি বলছি সেগুলো শুনতে তখনো ভালো লাগত না, এখনো লাগে না। বড্ড বিরক্তিকর একটি শব্দ এই করোনা। তবু তাকে বর্জন করে চলা যায়। কিন্তু 2020 তে দাঁড়িয়ে আমরা সারাক্ষণ যে 'করোনা' শুনছি তাকে কি বর্জন করা যায়; না যায় না, এই ভয়াবহ, আগ্রাসী একটি ভাইরাসকে সঙ্গে নিয়েই তো আমাদের চলতে হচ্ছে বা ভবিষ্যতেও হবে। সত্যিই এ এক বিভীষিকা।
লকডাউনে ব্রাসেল্স
গত তিন বছর যাবত্ আমি ব্রাসেল্সের বাসিন্দা, অভিবাসী বলাই শ্রেয়। এখানে মার্চ মাসের প্রথম দিন থেকেই করোনার অবাধ যাতায়াত শুরু হয়ে গেছে। এর আগে চীনে এই করোনার প্রভাবে ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা নিউজে দেখেছি কিন্তু তখনো বোধহয় আমরা তার ভয়াবহতা বুঝে উঠতে পারিনি।
ইউরোপের পালা এবার। ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি নাগাদ ইতালি থেকে করোনা পজিটিভ এর খবর আসতে থাকে। এর পোষাকী নাম 'COVID-19'। কি দেখে বোঝা যায় কোনো ব্যক্তি করোনা আক্রান্ত ; এর উত্তরে এক কথায় বলতে পারি প্রশ্নটা সহজ হলেও উত্তরটা বেশ জটিল। প্রথমদিকে এটিকে একটি সাধারণ ফ্লু-এর বেশি ভাবতে নারাজ থাকলেও দিনে দিনে এর শক্তি দেখে বিশেষজ্ঞ এবং ডাক্তাররা সত্যিই চমকেছেন। এবার আসি বেলজিয়াম তথা ব্রাসেল্স এর কথায়। এর আগে ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে আমরা ডেনমার্ক ও সুইডেন ঘুরতে গিয়েছিলাম। ওখানে থাকতেই সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে খবর পাচ্ছিলাম অনেক দেশেই করোনার ছোবল শুধু হয়ে গেছে। বেলজিয়াম তখনো নিরাপদ ছিল। কিন্তু না মার্চের প্রথম দিন থেকে বেলজিয়ামেও করোনা চলে এল। ঠিক এর দশ দিন পর থেকেই করোনা আক্রান্তের সংখ্যা সব জায়গাতেই নাগালের বাইরে চলে যেতে থাকে। ইতালিতে লকডাউন শুরু হল। আসলে করোনা খুব ছোঁয়াচে, তাই এতে আক্রান্তের সংস্পর্শে আসা প্রত্যেকটি মানুষই আক্রান্ত হতে পারে। তাই তাকে আলাদা রাখতে হয়। আর এর সঙ্গে সঙ্গে আমরাও আরো দু-তিনটি শব্দকে রোজকার জীবনে সঙ্গী করে নিলাম - কোয়ারাণ্টিন, লকডাউন, সোশ্যাল-ডিস্ট্যান্স ইত্যাদি।
এখানেও ধীরে ধীরে আগুন ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে। আজ এক জন তো কাল দশ জন। সত্যি বলতে মেয়েকে স্কুল পাঠাতে ভয় পাচ্ছিলাম। বারবার করে হাত স্যানিটাইজ করা, টিস্যু ব্যবহার করা, কারো বেশি কাছে গিয়ে কথা না বলা; মুখে, নাকে, চোখে হাত না দেওয়া; এগুলো বারণ করলেও চিন্তা তো থেকেই যায়। সেও যে ছোট্ট একটা মানুষ, এত কি বেচারা খেয়াল রাখতে পারে। আর এরই মধ্যে এখানেও করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বেশ বেড়ে যাওয়ায় লকডাউন ঘোষণা করে দিল বেলজিয়াম সরকার; অর্থাৎ সবাই বাড়িতেই থাকবে, স্কুল, অফিস, দোকান সব বন্ধ। শুধুমাত্র জরুরি জিনিস অর্থাৎ খাবার আর ওষুধের দোকান খোলা থাকবে। অফিসের কাজ বাড়ি থেকে হবে অর্থাৎ work from home আর বাচ্ছারা বাড়ি থেকেই online class করবে প্রয়োজনে। যাক একটু নিশ্চিন্ত হলাম বোধহয়, আমার ঘরের মানুষগুলো অন্তত ঘরেই থাকতে পারবে। আর এর সঙ্গেই আর একটা কথা প্রায় শ্লোগানের মতো হয়ে গেল stay home stay safe. সত্যিই তো বাইরে বেরিয়ে দরকার কি বাবা, শুধু শুধু ডেকে বিপদ আনা বই তো নয়। ঐ সপ্তাহে একদিন বেরিয়ে যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে আনাই শুরু হলো আমাদের।
অন্যদিকে পাশাপাশি দেশগুলোতেও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে করোনার প্রকোপ। তবে সবথেকে ভয়াবহ পরিস্থিতি ইতালিতে। মৃত্যুর সংখ্যাও বেড়ে চলেছে। হঠাৎ করেই ইতালির জন্য যেন মন কেমন করে উঠল। কি প্রাণবন্ত একটা দেশ ও তার লোকজন। গত ডিসেম্বরে আমরা দ্বিতীয়বারের জন্য ইতালি বেড়াতে গিয়েছিলাম ; মিলান - ফ্লোরেন্স, পিসা আর সাঙ্কতেরে (Cinque terre)। নিউজে ইতালির বিভিন্ন জায়গার ছবি আর আমার দেখা ইতালির মধ্যে কোনো মিল পাচ্ছি না, আমি তো দেখে এসেছিলাম প্রাণবন্ত সব শহর, আর এখন তো মৃত্যুপুরী। অন্যান্য দেশ, মহাদেশের অবস্থাও তথৈবচ; এমনকি সর্বশক্তিমান আমেরিকাও যেন দিশেহারা।
আর এই রোগ সব থেকে বেশি প্রকোপ ফেলেছে বয়স্ক মানুষদের উপর। তাদের যে এখন প্রাণশক্তির বড্ড অভাব, তারা কি করে পাল্লা দিয়ে লড়বে এই দানবীয় করোনা ভাইরাসের সাথে। এরই মধ্যে আমার দেশেও করোনা বেশ গভীরে পৌঁছে গেছে ; সেখানেও যে বাড়িতে বয়স্ক বাবা মা আছেন। সত্যিই খুব চিন্তার, এত দূর দেশে বসে ঐ ফোনে তাদের আশ্বাস দেওয়া ছাড়া আর কিই বা করতে পারি। হঠাৎ একদিন একজনের কথা মনে পড়তে মনটা ভারী হয়ে গেল ; না তিনি আমার কোনো আত্মীয় বা বন্ধু নন। তিনি আমার সঙ্গে নিছক এক ঘন্টার পরিচিত এক ব্যক্তি; বাস ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে, পেশায় ওখানকার বিখ্যাত একটি চার্চের গাইড। সেই সত্তরোর্দ্ধ মানুষটি, তার কথনশৈলীতে সেই চার্চ আর পুরোনো ফ্লোরেন্সের ইতিহাস যেন জীবন্ত করে তুলেছিলেন আমাদের কাছে। কি জানি সেই মানুষটি কেমন আছেন; এ যে এক বড্ড নষ্ট দূষিত সময়, বড্ড অচেনা।
জানিনা এরপর কি হবে। আমাদের ভবিষ্যতই বা কি। আমরা কি আর কোনো দিন আমাদের আগের জীবনে ফিরতে পারবো; না বোধহয়। তাই নতুন আরেক শব্দ উঠে আসছে এখন 'new normal'। মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস নিয়ে চলা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা new normal তো বটেই।
সুমনা
07.05.20
Comments
Post a Comment