আমার 36 চৌরঙ্গী লেন
তিন তিনটে বছর, 1096 টা দিন কাটিয়ে ফেললাম আমার এই 36 চৌরঙ্গী লেনে। হ্যাঁ, 36 চৌরঙ্গী লেন'ই বটে, বাড়ির নম্বরটা 36, আর রাস্তার নামে কি আসে যায়। আর তিন বছরের হিসাবটাও কিন্তু লিপইয়ার সমেত, তাই একটা দিন বেশি। কি আছে আমার এই 36 চৌরঙ্গী লেন-এ; ওটাই যে আমার ঠিকানা, আমার বাড়ি। না সে অর্থে আমার বাড়িতে তেমন কোনো গুপ্তধন নেই, নেই কোনো দামি আসবাবপত্র বা দামি কোনো বিলাসসামগ্রী। তবে আছে এর থেকেও দামি কিছু স্মৃতি, কিছু সময়, অনেকটা ভালোবাসা; যেখানে নেই কোনো ফাঁকি, আছে শুধু অনেকখানি যত্ন আর আন্তরিকতা দিয়ে গড়ে তোলা কিছু মুহূর্ত।
রাস্তার সবুজ গাছের সারি |
আমিই এই বাড়িটা প্রথম দেখি এক বৃষ্টিস্নাত দিনে। বেশ লেগেছিল বাড়ির সামনের রাস্তাটা। রাস্তার দুধারে সার দেওয়া লম্বা লম্বা সবুজ গাছগুলো যেন সবাইকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। এরপর যেদিন বাড়িটিতে আসি বিকেলবেলা বেশ অন্যরকম লেগেছিল। তখন রোদ্দুর যেন খেলা করছে আপনমনে। বাড়িটাতে ঢুকতেই অদ্ভুত একটা গন্ধ পেয়েছিলাম সেদিন, আমার ছোটবেলায় এরকম একটা সুন্দর গন্ধের সঙ্গে আমার বেশ পরিচিতি থাকলেও কিসের গন্ধ তা বলতে পারবো না; তবে তা ছিল বেশ নষ্টালজিয়া মেশানো। যদিও পরে আর কোনোদিন সেটা অনুভব করিনি।
সব বাড়ির মতো আমার বাড়িতেও রয়েছে আমাদের অনেক স্মৃতি। আমার সেদিনের সেই পাঁচ বছরের দাঁত ফোকলা মেয়েটা এই ক'বছরেই বেশ বড়ো হয়ে কেমন petit madame হয়ে গেছে। সে তখন ভালো করে ফরাসি (French) ভাষা বলতে বা বুঝতে না পারলেও আজ সেই আমাদের বিপত্তারিণী এই ভাষাটির জন্য। তার জীবনের এই গত তিনটি বছরের সঙ্গে কেমন যেন অজান্তেই জড়িয়ে গেল বাড়িটা। এই বাড়িতে থাকতেই আমি যেমন পেয়েছি প্রিয়জন হারানোর দুঃসংবাদ তেমনি পেয়েছি নিজের একটা সৃষ্টি কিভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয় তার অভিজ্ঞতা।
দাবা আর পিয়ানো |
আমার এই বাড়ির কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। এখানে আমরা যা ইচ্ছে তাই করতে পারি, কিন্তু যাচ্ছেতাই করতে পারি না। এখানে সবাই সবার লেগ পুলিং করতে ব্যস্ত। প্রকৃত নাম ছাড়া অন্য সব নামেই সবাই সবাইকে সারাক্ষণ ডাকছে। কেউ চেঁচাচ্ছে (অবশ্যই আমি ), তো অন্যজন চুপ থেকে তাকে ব্যালেন্স করছে; একজন হাসাচ্ছে তো আরেকজন তার দমফাটা হাসিতে বলে যাচ্ছে 'প্লিস্ আর না, আর পারছি না, পেট ফেটে যাবে এবার'। আবার কেউ দাবা খেলায় প্রতিপক্ষের রাজাকে উল্টে দিয়ে উদ্দাম নৃত্যে বাড়ি মাথায় করে ফেলছে। অফুরন্ত প্রাণ শক্তিতে ভরপুর আমার এই বাড়ি। সবকিছুতেই তাই হয়তো আমরা 'চাপ নিয়ে লাভ নেই, take it easy' গোত্রের। আসলে আমার এই 36 চৌরঙ্গী লেন আমার বৈভব নয়, আমার যাপনের কথা বলে। আমি বিশ্বাস করি অর্থের বিনিময়ে বৈভব কেনা যায় কিন্তু যাপন না। তবে এ তো গেল 36 চৌরঙ্গী লেনের অভ্যন্তর, কিন্তু বহিরাঙ্গিকেও এ যে বড্ড সুন্দর।
চেরি ব্লসম |
এখান থেকে প্রায় ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে রয়েছে ইউরোপের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি কেন্দ্র; ইউরোপীয় ইউনিয়ন (European Union)-এর প্রধান কার্যালয় ও পার্লামেন্ট। ব্রাসেল্স এমনই একটা জায়গা যেখানে পুরোনো বাড়ি আর স্থাপত্য খুঁজতে হয় না, শহরের আনাচে কানাচে তা ছড়িয়ে রয়েছে। আমার বাড়ির আশপাশও তার ব্যতিক্রম নয়। উল্টোদিকের বাড়িটি 1822 সালের। এরকম ঊনবিংশ শতাব্দীর বহু বাড়ি চারপাশে ছড়িয়ে আছে। পথে চলতে চলতে সেদিন হঠাৎই চোখে পড়ল একটি বাড়ির সদর দরজার দিকে। ঠিক দরজার উপরে একটা ভাস্কর্য, যেন মনে হচ্ছে সমস্ত বিপদ থেকে সে বাড়িটিকে রক্ষা করছে। বাড়ি থেকে বেড়িয়ে অন্য প্রান্তে রয়েছে সারি দিয়ে চেরি ব্লসমের(cherry blossom) গাছ, সেগুলো বসন্তের শুরুতে তার রূপ লাবণ্যে আমাদের বুঁদ করে রাখে। আছে আরো অনেক কিছু চৌরাস্তার মোড়ের এই বাড়িটিতে। বাড়ির দুদিকে দুটি পাব, যাদের সঙ্গে আমার কোনোদিনের লেনা দেনার সম্পর্ক না থাকলেও সেগুলো যেন বড্ড আপন। সেখানে প্রায় সারাদিন কত মানুষের আড্ডা, তাদের হাসি যেন সবসময় আমাদের জাগিয়ে রেখেছে।
ব্রাসেল্সের ভাস্কর্য |
আবার আসি বাড়ির অভ্যন্তরে। সেদিনের সেই ছোট্ট মেয়েটি আজ রোজ গাছে জল দেয়। নিজের হাতে বীজ পুঁতে অপেক্ষা করে কবে চারা আসবে। সবুজের চিহ্ন দেখতে পেলে তার মুখটা হাসিতে ভরে ওঠে। বাড়ির সকলের উত্সাহে অতিক্ষুদ্র বারান্দাটাই আজ রংবেরঙের বাহারী ফুলে ভরে গেছে। এখানে একই সঙ্গে এখন কড়াই-খুন্তির খুটখাট আর পিয়ানোয় 'I found a love' বা বিটোফেনে'র 'ফার এলিস্' (Für Elise) বেজে ওঠে। সবকিছুরই যেন সহাবস্থান আমার এই 36 চৌরঙ্গী লেনে।
রংবেরঙের ফুলে ভরা বারান্দা |
এই 36 চৌরঙ্গী লেন সব সময়ই থাকবে আমাদের মনে। আমাদের এই ইউরোপ প্রবাসের সঙ্গে এটি ওতপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছে, থাকবে। মনে থাকবে এই বাড়িতেই আমরা কাটিয়েছি আমাদের দশম বিবাহবার্ষিকী। আমার মেয়েরও প্রথম ফেলুদা, প্রথম হ্যারিপটার, প্রথম স্নোফল, প্রথম রামধনু দেখার সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই বাড়ি। উফফ্ অনেক প্রথম কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই বাড়ি। সে যখনই তার ছোটবেলার কথা ভাববে অজান্তেই এই বাড়ি চলে আসবে তার মনে। এই 2020তে করোনার মোকাবিলায় লকডাউনের দিনগুলোর কথা মনে করলেই তো এই বাড়ি হাতছানি দিয়ে ডাকবে আমাদের স্মৃতিকোটরে।
ছোটবেলায় শুনেছিলাম বাড়ি মানে শুধু চারটে দেওয়াল বা ইট-কাঠ পাথরের খাঁচা নয়। বাড়ি মানে কয়েকটা মানুষ তাদের সুখ-দুঃখ, কিছু স্মৃতি। সত্যিই তাই, আজ যা অনুভব করতে শিখেছি। কর্মসূত্রে অনেক জায়গার সঙ্গে সঙ্গে অনেকবার বাড়ি বদলেরও সুযোগ ঘটেছে গত কয়েক বছরে। সব বাড়িগুলোই আমার কাছে প্রিয়; কিন্তু এই বাড়িটা যেন কোথাও একটু আলাদা, জানিনা তা আমাদের প্রবাসের ঠিকানা বলে, নাকি অন্য কোনো কারণে। হয়তো বা এই বাড়ি আমার রাজকন্যার ছোটবেলার একটা বড়ো অংশ হওয়ার কারণে। জানিনা কি কারণ আর আমার বিশ্বাস এর কারণ খুঁজে বের করা স্বয়ং ফেলুদারও অসাধ্য। তাই আর নাই বা ভাবলাম ওসব নিয়ে, শুধুই ভাবি আমার 36 চৌরঙ্গী লেনের মুহূর্ত নিয়ে।
সুমনা
14.06.2020
Khub sundor
ReplyDeleteThanks
ReplyDelete